
আপনাদের শুরুর সময়ের সাহিত্যের পরিবেশ এখনকার পরিবেশ মিলালে ইতিবাচক বা নেতিবাচক কোন ভিন্নতা চোখে পড়ে?
: আমাদের শুরুর সময়ে সাহিত্যের প্রতি মানুষের পিপাসা ছিল। চিত্ত আকুল হয়ে থাকত একটি ভালো কবিতা একটি সুন্দর গল্প একটি নতুন বই পড়ার জন্য। এখন মানুষ বিত্ত পূজারি। যে কোনো উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জনের জন্য পাগলের মতো ছুটছে। বিত্ত মানুষের চিত্তের বিনাশ ঘটাচ্ছে অহরহ। আর এর প্রভাবও পড়ছে বর্তমান সাহিত্যে।
প্রযুক্তির পুঁজিবাদি সময়ে একজন লেখক তার লেখক সত্ত্বাকে কতটা লালন করতে পারে?
: সময়ের বহমান স্রোতধারাকে উপেক্ষা করা যায় না। তবে স্রোতের এ গড্ডালিকা প্রবাহে ভেসেও যাওয়া যাবে না। পুঁজিবাদ এবং প্রযুক্তি কোনো মন্দ জিনিস নয় তবে এর যথাযথ ব্যাবহারই মূলকথা। পুঁজিবাদের নেতিবাচক এবং ইতিবাচক দুটি দিকই আছে। এক্ষেত্রে পুঁজিপতিদের দৃষ্টিভঙ্গিই মুখ্য। ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক আগ্রাসী পুঁজিবাদ লেখক সত্তার জন্য হুমকি স্বরূপ।
লেখক হওয়ার জন্য শহরে/কেন্দ্রে চলে আসার প্রবণতাকে কীভাবে দেখেন?
: এক সময় লেখকদের আকাক্সক্ষা ছিল কলকাতা যাওয়া। এখন সে স্থান দখল করে নিয়েছে ঢাকা। যেহেতু প্রকাশ প্রকাশনা ছাপাখানা থেকে বই মেলা; বিউটি বোর্ডিং থেকে আজিজ সুপার মার্কেট সবই ঢাকায়, সব বড় বড় সাহিত্যিকের বসবাসও ঢাকায় তাই একজন লেখকের ঢাকায় বা কেন্দ্রে আসার প্রবণতা থাকতেই পারে। তবে আমার মতে একটা সময় গ্রামে পার না করে হুট করে, শহরে আসা উচিত নয়। গ্রাম, গ্রামের প্রকৃতি, গ্রামের মানুষ, তাদের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না আয়ত্ব করে হৃদয়ে গ্রামের গাঁথুনিটি আগে সেঁটে তারপর শহরমুখী হওয়া উচিত।
বর্তমানে সাহিত্যে কোন বিষয়গুলো প্রাধান্য পাচ্ছে। কোন বিষয়গুলো বেশি প্রাধান্য পাওয়া উচিত?
: বর্তমান সাহিত্যে কিছু কিছু তরুণের মধ্যে নতুন ধারা তৈরির প্রবণতা লক্ষ করা যায় যা ইতিবাচক। তবে মানহীন সস্তাগোছের বই প্রকাশের প্রবণতাও কম নয়। জীবনানন্দ দাশ বলেছেন ‘সকলেই কবি নয় কেউ কেউ কবি’ এই কেউ কেউ কবির সংখ্যা বর্তমানে খুব কম। আমার মতে বর্তমান সাহিত্য তুলনামূলকভাবে মানুষ এবং প্রকৃতিকে উপেক্ষা করছে। সমাজে বৈষম্য দিন দিন প্রকটভাবে বেড়ে চলেছে। ধনী কেবলই ঊর্ধ্বমুখী; ধনী হচ্ছে, গরিব কেবলই নিন্মুমুখী; আরও গরিব হচ্ছে। সম্পদের আসল মালিকরা সবদিক থেকে সুবিধাবঞ্চিত। অন্যদিকে লুটেরারা সব তাদের গোলায় নিয়ে ভরছে। তাদের আগ্রাসনের হাত থেকে কেউ রেহাই পাচ্ছে না। সমাজে মানুষের প্রতি মানুষের কমিটমেন্ট নেই, সম্পর্ক নেই ভালোবাসা নেই। সমাজটা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। এ আঁধার দূর করার জন্য চাই মহৎপ্রাণ লেখক। চাই সাধনাব্রতী সাহিত্যিক।
দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতায় ভালোবাসার সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার মূল্যায়ন-
: কেউ ভালোবাসার কথা বললে আমার ভেতর থেকে দীর্ঘ না হলেও বেদনার একটি হ্রস্য শ্বাস বের হয়ে আসে। এক সময় যুবক-যুবতী কিশোর-কিশোরীদের ভালোবাসা ছিল এত পবিত্র এবং স্বর্গীয় যে দীর্ঘ সময় একসঙ্গে থেকেও তোমাকে ভালোবাসি এ কথাটি বলার অবসর পেত না অথচ তারা চিরকাল সে ভালোবাসা পবিত্র আমানত হিসাবে হৃদয়ে লালন করত। এখন সকালের ভালোবাসা বিকালে ভেঙে যায়। এখন মুখের হাসি, হাতের বাঁশি দেখে প্রেমে পড়ে না। এখন হৃদয় নয় অর্থবিত্ত বাড়ি গাড়ি প্রভাব প্রতিপত্তিই আসল। এক সময় ভালো চাকরির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও গ্রামকে ভালোবেসে অথবা বৃদ্ধ পিতা-মাতার কষ্ট হবে এ কথা ভেবে গ্রামে সামান্য বেতনে মাস্টারি চাকরি করত শিক্ষিত যুবক। এখন তারা বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য অস্থির। কোথায় দেশের মায়া, কোথায় স্বজনের প্রতি টান। মানুষের প্রতি মানুষের এ আবেগহীন বিমুখতা বড়ই বেদনাদায়ক।
আমাদের বর্তমান সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানুষ জীবন কতটা নিজস্ব সৌন্দর্যে বহমান, কতটা বিকৃতির শিকার?
: প্রকৃতির নিরাপদ কোল না পেলে মানুষ পৃথিবীর বুকে তার অস্তিত্ব নিয়ে টিকে থাকতে পারত না। কোনো অজানা কারণে যদি মানুষের অস্তিত্ব বিলীনও হয়ে যায় প্রকৃতি ঠিকই টিকে থাকবে। কিন্তু প্রকৃতি না বাঁচলে মানুষের অস্তিত্ব থাকবে না। আমরা লকডাউনের সময় যখন ঘরবন্দি ছিলাম তখন তার কিছুটা লক্ষণ দেখেছি। বর্তমানে প্রকৃতির প্রতি মানুষের ভালোবাসা কমে গেছে। সাহিত্যে প্রকৃতি ও মানব জীবনের সৌন্দর্য ফিকে হয়ে যাচ্ছে। বিভূতিভূষণ, মানিক ও মহেশ্বেতা দেবীদের বড় বড় সৃষ্টির কথা নাই বলি রবীন্দ্রনাথের ছোট একটি গল্প ‘বলাই’ আমাদের কিশোর মনে কি দারুণ দাগ কেটেছিল আজও বলাই-এর কথা ভুলতে পারি না। আজও একটি শিমুল গাছ দেখলে ভালো লাগে, গল্পের বলাই-এর কথা মনে পড়ে। মনে হয় বলাই যেন আমাদের আপনজন, আমাদের জ্ঞাতি ভাই। সাহিত্যে মানুষ আর প্রকৃতির সেই সৌন্দর্য এখন কোথায়!
শরীয়তপুরে সাহিত্যচর্চার বর্তমান অবস্থা কেমন? কোন কোন দিকে যত্ন নিলে আরও সক্রিয় হতে পারে?
: এক সময় শরীয়তপুর ছিল সাহিত্যের উর্বর ভূমি। এ মাটিতে জন্ম নিয়েছেন অনেক দেশবরেণ্য গুণী ব্যক্তিত্ব। বর্তমানেও শরীয়তপুরে প্রতিভাবান প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ সাহিত্যিক আছেন। যাদের অনেক প্রকাশনাও আছে। তবে তারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। একটি প্রাণবন্ত আড্ডাস্থল না থাকায় কেউ একত্রিত হচ্ছে না। আমার মতে আড্ডা পরাগায়নের মতো কাজ করে সাহিত্যকে বিকশিত করে। আড্ডাহীন সাহিত্য তৈলাধারপূর্ণ অপ্রজ্জ্বলিত প্রদীপের মতো। এ বিচ্ছিন্নতা ও আজ্ঞাহীনতার কারণে শরীয়তপুরের সাহিত্য কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারছে না। এর থেকে উত্তোরণের জন্য আমাদের একত্রিত হওয়া ছাড়া পথ নেই। নিয়মিত সাহিত্যচর্চার আসর, পরস্পরের লেখার পর্যালোচনা, সমালোচনা হওয়া দরকার। নিয়মিত একাধিক লিটল ম্যাগ প্রকাশ হওয়া উচিত। শুধু কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ না দিয়ে কেন্দ্র থেকে দেশ বরেণ্য সাহিত্যিকদের এনে বিভিন্ন সাহিত্য অনুষ্ঠান করা উচিত। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা থাকা জরুরি।