
আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, অনেকে অনেক কথা বলেন। কেউ কেউ আওয়ামী লীগের সঙ্গে বিএনপির তুলনা করেন। কেউ কেউ বলেন দুই দল। একটা কথা বলতে চাই, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি ৩০০ আসনের মধ্যে পেয়েছিল মাত্র ৩০টি। আওয়ামী লীগ মহাজোট করেছিল। বিএনপির ছিল ২০ দলীয় জোট। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, তাহলে দুই দল এক পর্যায় হয় কীভাবে? বিএনপি সরকারের আমলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, গ্রেনেড হামলা, ৬৩ জেলায় বোমা হামলা হয়েছিল। তারা দুর্নীতিতে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। ওরা মানুষকে কিছু দেয়নি। মানুষের অর্থকড়ি সব লুটপাট করে বিদেশে নিয়ে গেছে। তারা এমন রাজনৈতিক দল, যারা নিজেদের গঠনতন্ত্রও মানে না। শনিবার গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় তালিমপুর তেলিহাটি উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে উপজেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। তিনি আরও বলেন, বিএনপির গঠনতন্ত্রে আছে সাজাপ্রাপ্ত আসামি দলের নেতা হতে পারে না। কিন্তু বিএনপির একটা নেতাও তা বলে না। খালেদা জিয়া ও তার ছেলে দুজনেই সাজাপ্রাপ্ত আসামি। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ও ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা থেকে শুরু করে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালেদা জিয়ার ছেলে সেই দলের নেতা। ওরা (বিএনপি) নিয়ম মানে না। আইন মানে না। সেই দলের সঙ্গে আওয়ামী লীগের তুলনা চলে না। যারা দুটি বড় দল বলেন, তারা ভুল করেন।
সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত থাকবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের ভাগ্য গড়তে ক্ষমতায় এসেছি। তাই যখন কেউ মিথ্যা অপবাদ দেয়, সেই অপবাদ মেনে নিতে আমি রাজি না। বিশ্বব্যাংক মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাতে তারা সফল হয়নি। আমরা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছি বলেই এত দ্রুত গোপালগঞ্জ, কোটালীপাড়া ও টুঙ্গিপাড়া আসতে পারছি। দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে পেরেছি। বাংলাদেশের মানুষ অত্মমর্যাদা নিয়েই চলে। আমাদের অপবাদ দিলে আমরা তা মানব না। তাই জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস, মাদক ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে। সবাই সতর্ক থাকবেন। নিজেদের সন্তান যেন মাদক বা জঙ্গিবাদে সম্পৃক্ত না হয়।
দুর্নীতি করে নিজের ভাগ্য গড়তে আসিনি : প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের সাধারণ মানুষ ও দরিদ্র মানুষের কল্যাণে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। আজ সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়েছে। হতদরিদ্র, বিধবা, বয়স্ক ও স্বামী পরিত্যক্তাদের ভাতা দিচ্ছি। হতদরিদ্রদের বিনা পয়সায় খাবার আমরা বিতরণ করছি। ছাত্রছাত্রীদের প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত বৃত্তি-উপবৃত্তি দিয়ে যাচ্ছি। এমনকি যারা প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, তারা ভাতা পাচ্ছেন এবং প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদেরও আমরা বৃত্তি-উপবৃত্তি দিচ্ছি। যাতে তারাও পড়ালেখা করতে পারে, সেই সুযোগ আমরা সৃষ্টি করে দিচ্ছি।
তিনি আরও বলেন, যেখানে সরকারি স্কুল-কলেজ ছিল না, স্কুল-কলেজ করে দিয়েছি। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধু ৩৬ হাজার প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ করেছিলেন। জাতির পিতাকে হত্যার পর জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া ক্ষমতায় এসেছে, কেউ কিন্তু প্রাইমারি স্কুল সরকারীকরণ করেনি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতার আসার পর আমরা ২৬ হাজার স্কুল সরকারীকরণ করেছি। অনেক স্কুল ও মাদ্রাসা আমরা এমপিওভুক্ত করে শিক্ষকদের বেতনভাতা ও মর্যাদা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করেছি। প্রতিটি স্কুলে ডিজিটাল ও কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করেছি। ডিজিটাল বাংলাদেশ তৈরি করেছি। শিশুকাল থেকেই যাতে তারা কম্পিউটার প্রশিক্ষণ পায়, সেই ব্যবস্থা করে দিয়েছি।
ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ : শেখ হাসিনা বলেন, ওয়াদা করেছিলাম সব ঘর অলোকিত করব। আজ ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ দিতে পেরেছি। আপনারাই আমাকে সেই শক্তি দিয়েছেন। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে সাশ্রয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিশ্ববাজারে তেল, গ্যাসসহ সবকিছুর মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাই সাশ্রয়ী হবেন। যত কম ব্যবহার করা যায়। বিদেশে এমনকি লন্ডনেও প্রায় বিদ্যুতের দাম বেড়েছে দেড় শ ভাগ। আমরা কিন্তু যে টাকা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করি, এর অর্ধেক মূল্যে দিচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী এ সময় কমিউনিটি ক্লিনিক, মাতৃসদন, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে মানুষকে বিনা পয়সায় ৩০ প্রকার ওষুধ দেওয়া, ভূমিহীনদের ঘর করে দেওয়াসহ বর্তমান সরকারের নানা উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফিরিস্তি তুলে ধরেন।
প্রধানমন্ত্রী কৃষকদের উদ্দেশে বলেন, আমাদের কৃষক কষ্ট করে চাষবাস করেন। বর্গাচাষি যারা, তারা কখনো ব্যাংকে ঋণ পেতেন না। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বর্গাচাষিরা বিনা জামানতে কৃষি ব্যাংকের ঋণ যাতে নিতে পারেন, সেই ব্যবস্থা আওয়ামী লীগ সরকার করে দিয়েছে। কৃষকের উপকরণ কার্ড আমরা দিচ্ছি। পাশাপাশি ১০ টাকায় ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলে ভর্তুকির টাকা সরাসরি পাওয়ার ব্যবস্থা করেছি। কৃষক যাতে ন্যায্য মূল্য পান, সেই ব্যবস্থাও আমরা করে দিয়েছি। তিনি বলেন, আজ সবার হাতে মোবাইল ফোন। ডিজিটাল বাংলাদেশ শুধু মুখে বলা নয়, প্রতিটি অঞ্চলেই যাতে সবাই ইন্টারনেট সার্ভিস পায়, ব্রডব্যান্ড সার্ভিস পায়, সেই ব্যবস্থা আমারা করে দিয়েছি।
বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে : প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ আজ এগিয়ে যাচ্ছে। সারা বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। করোনা যেমন মোকাবিলা করেছি, আজ আমরা দারিদ্র্যবিমোচনও করছি। বিএনপির আমলে যা ৪০ ভাগ ছিল, আমরা তা ২০ ভাগে নামিয়ে এনেছি। যদি করোনার অতিমারি ও ইউক্রেন যুদ্ধ না হতো, তাহলে দেশকে আরও উন্নতির পথে নিয়ে যেতে পারতাম। এরপরও আমি বলব, আমাদের মাটি উর্বর, আমাদের মানুষ আছে। দেশকে আমরা উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাব। তিনি আরও বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার সুফল বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছেছে। ইনশাআল্লাহ, আরও পৌঁছাবে।
কোটালীপাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভবেন্দ্র নাথ বিশ্বাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম, উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য কাজী আকরাম উদ্দিন আহম্মদ, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাহজাহান খান, যুগ্মসাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, প্রচার সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম, গোপালগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মাহবুব আলী খান, সাধারণ সম্পাদক জিএম শাহাব উদ্দিন আজম, গোপালগঞ্জ পৌরসভার মেয়র শেখ রাকিব হোসেন, কোটালীপাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান বিমল কৃষ্ণ বিশ্বাস, আওয়ামী লীগ নেতা এসএম হুমায়ূন কবীর, মুজিবুর রহমান হাওলাদার, কোটালীপাড়া পৌরসভার নবনির্বাচিত মেয়র মতিয়ার রহমান হাজরা প্রমুখ। সঞ্চলনা করেন কোটালীপাড়া আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আয়নাল হোসেন শেখ।
এদিকে দীর্ঘ চার বছর পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নির্বাচনি এলাকা কোটালীপাড়ায় যান। তার জনসভাকে কেন্দ্র করে শনিবার ভোর থেকেই কোটালীপাড়ার বিভিন্ন এলাকা থেকে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থল উপজেলার তালিমপুর তেলিহাটি উচ্চবিদ্যালয় মাঠে সমবেত হতে থাকেন। মিছিল স্লোগানে মুখরিত হয় পুরো এলাকা। সকাল ৯টার মধ্যে জনসভাস্থল কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। রংবেরঙের ব্যানার নিয়ে বাজনা বাজিয়ে বিভিন্ন বয়সের নারী-পুরুষ জনসভায় যোগ দেন। বাসন্তী রঙের শাড়ি ও সাদা টি-শার্ট পরে মিছিল নিয়ে নারী-পুরুষদের জনসভাস্থলে আসার দৃশ্য ছিল চোখে পড়ার মতো।
সকাল ১০টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকা থেকে সড়কপথে কোটালীপাড়া বঙ্গবন্ধু দারিদ্র্যবিমোচন ও পল্লি উন্নয়ন একাডেমিতে পৌঁছান। সেখানে তিনি পৌনে ২ ঘণ্টা অবস্থান করার পর দুপুর সাড়ে ১২টায় জনসভা মঞ্চে উপস্থিত হন। পরে তিনি কোটালীপাড়ার ৪৩টি প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৫টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। প্রধানমন্ত্রী তার ২৫ মিনিটের বক্তব্যের পর সভা শেষে সড়কপথে টুঙ্গিপাড়ার উদ্দেশে রওয়ানা হন। সেখানে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ, ফাতেহাপাঠ ও মোনাজাতে অংশ নেন। বিকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দেন।
ষষ্ঠবারের মতো পদ্মা সেতু পার হলেন প্রধানমন্ত্রী : লৌহজং (মুন্সীগঞ্জ) প্রতিনিধি জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উদ্বোধনের আট মাসের মধ্যে ষষ্ঠবারের মতো পদ্মা সেতু অতিক্রম করলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গাড়িবহর শনিবার সকাল ৮টা ৪৩ মিনিটে মাওয়াপ্রান্ত দিয়ে পদ্মা সেতুতে ওঠে। এর আগে প্রধানমন্ত্রী মাওয়া টোল প্লাজায় ৬ নম্বর লেন দিয়ে প্রবেশ করেন ৮টা ৪২ মিনিটে। বহরের ১২টি গাড়ির ১১ হাজার ৬৫০ টাকা টোল পরিশোধ করা হয়।
সরকার প্রধানের পদ্মা সেতু অতিক্রম ঘিরে পদ্মার দুই পারের মানুষ ছিলেন উচ্ছ্বসিত। সেতু অতিক্রমের সময় প্রধানমন্ত্রী ফাল্গুনে শিশিরঝরা সকালের রূপ উপভোগ করতে করতে সেতু পার হন। এর আগে প্রধানমন্ত্রী গত বছরের ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধন করে প্রথম সেতু অতিক্রম করেন।
এর ১০ দিনের মাথায় ৪ জুলাই ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয় ও কন্যা সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ পদ্মা সেতু পাড়ি দেন। ৪৯ দিনের মাথায় ১২ আগস্ট ভাগনে রাদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববিসহ পদ্মা সেতু পার হন সরকার প্রধান। ৭ অক্টোবর ১০৫ দিনের মাথায় বোন শেখ রেহানাকে সঙ্গে নিয়ে চতুর্থবারের মতো পদ্মা সেতু অতিক্রম করেছিলেন। আর চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পঞ্চমবারের মতো সেতু অতিক্রম করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।