
জামিনি মিষ্টান্ন ভান্ডারের রসগোল্লা, সন্দেশ আর ছানার পোলাওয়ের সুনাম শরীয়তপুরের গণ্ডি ছেড়ে আশপাশের জেলায়ও। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা জামিনি দে। শত বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখে মিষ্টির দোকানটি পরিচালনা করছেন তাঁর নাতি জিতু দে। জেলার নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর বাজারে ১৯২২ সালে জামিনি মিষ্টান্ন ভান্ডারের যাত্রা শুরু। শত বছর ধরে তিন প্রজন্মের ব্যবসা তাঁদের।
স্থানীয় ব্যবসায়ী ও জামিনিদের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নড়িয়া উপজেলার পাঁচক গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন জামিনি দে। ১৯২২ সালে তিনি ২০ বছরের তরুণ। পরিবারের প্রয়োজনে তাঁকে ব্যবসা শুরু করতে হয়। শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার ভোজেশ্বর বাজার তখন জেলার অন্যতম কৃষিপণ্য বিক্রির হাট। সপ্তাহে দুই দিন জমজমাট হাট বসত। সেখানে তিনি মিষ্টির দোকান দেন। নিজের নামে দোকানের নাম রাখেন ‘জামিনি মিষ্টান্ন ভান্ডার’।
দোকানের পরিচিতি ছড়িয়ে দিতে ব্যতিক্রম ও ভিন্ন স্বাদের মিষ্টি তৈরিতে মনোযোগ দেন জামিনি দে। রসগোল্লা, সন্দেশ, দইয়ের সঙ্গে তিনি ছানার পোলাও তৈরি করে বিক্রি করতে থাকেন। অল্প সময়ের মধ্যেই তাঁর সুনাম ছড়িয়ে পড়ে।
পদ্মার শাখা কীর্তিনাশা নদীর তীরে ভোজেশ্বর বাজারটির অবস্থান। নৌপথে স্টিমারে করে কলকাতাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে নড়িয়ার মানুষ যাতায়াত করতেন। জামিনির তৈরি ছানার পোলাও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যেতেন এ অঞ্চলের মানুষ।
জামিনিদের চার ছেলে। এক ছেলে মারা গেছেন। আরেক ছেলে ভারতে বসবাস করছেন। বড় ছেলে পরিমল দে ১৯৬৫ সালে বাবার হাত ধরে মিষ্টি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৯৪ সালে জামিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর ছোট ছেলে বিমল দে বাবার ব্যবসায় যুক্ত হন। দোকানের আয় দিয়ে দুই ভাইয়ের সংসার চলতে থাকে। জামিনির বড় ছেলে পরিমল দের দুই ছেলে জিতু ও পবন এবং ছোট ছেলে বিমলের ছেলে সাগর দে কাতারপ্রবাসী। পরিমলের ছেলে জিতু ২০১৩ সাল থেকে বাবার সঙ্গে দোকানটি পরিচালনা করছেন। তাঁকে সহযোগিতা করেন ছোট ভাই পবন।
বর্তমানে জামিনি দে মিষ্টান্ন ভান্ডারের রসগোল্লা ও সন্দেশ বেশি জনপ্রিয়। জিনিসের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ছানার পোলাওয়ের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে, ফলে পণ্যটির চাহিদা কমেছে বলে মালিকপক্ষের ভাষ্য। অবশ্য অর্ডার পেলে মাঝেমধ্যে তা তৈরি করা হয়।
মিষ্টির কারিগর হিসেবে কাজ করেন চারজন। প্রধান কারিগর সুনীল পাল ৩০ বছর ধরে এখানে মিষ্টি তৈরির কাজ করেন। তিনি শরীয়তপুর চোখকে বলেন, প্রতিদিন গড়ে বিভিন্ন ধরনের পাঁচ থেকে ছয় মণ মিষ্টি তৈরি করা হয়। সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয় শুক্রবারে। সুনাম ধরে রাখার জন্য তাঁরা অনেক যত্ন, আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে মিষ্টি তৈরি করেন বলে দাবি করলেন।
জামিনি দের ছেলে পরিমল দে শরীয়তপুর চোখকে বলেন, ‘বাবা অনেক যত্নে দোকানটি পরিচালনা করতেন। তাঁর কাছ থেকেই ব্যবসার কৌশল ও সততা শিখেছি। এই দোকানই আমাদের পরিবারের একমাত্র অবলম্বন। বোনদের বিয়ে দেওয়া, নিজের ও ভাইয়ের ছেলে মেয়েদের পড়ালেখা ও বিয়েশাদির খরচের জোগাড়, সব হয়েছে এই দোকানের আয় থেকে।’
পরিমল দের ছেলে জিতু দে বলেন, ‘শত বছরের ব্যবধানে ভোজেশ্বর বাজারের অবস্থানগত ও পরিবেশগত অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আমাদের দোকানটির যেখানে অবস্থান, সেখানে লোকসমাগম এখন কম হয়। শুধু সুনামের কারণে ব্যবসাটি টিকিয়ে রাখতে পারছি। তবে খুব বেশি সাফল্য পাওয়া যাচ্ছে না। প্রতিষ্ঠানটি টিকিয়ে রাখার লড়াই চালি যাচ্ছি আমরা।’
ভোজেশ্বর উচ্চ বিদ্যালয়ের সাবেক প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক ও ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মাসুক আলী দেওয়ান শরীয়তপুর চোখকে বলেন, ‘বাবা-চাচাদের হাত ধরে শিশু বয়সে জামিনি দের দোকানে মিষ্টি খেতে যেতাম। উৎসব, পার্বণ হলেই ওই দোকানের মিষ্টি আসত বাড়িতে। শিশু বয়স থেকে পড়ন্ত বয়সেও দোকানটির মিষ্টির স্বাদ ও সুনাম একই রকম আছে।’
নড়িয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শংকর চন্দ্র বৈদ্য বলেন, নড়িয়ার একটি গ্রামীণ বাজারে শত বছর ধরে সুনামের সঙ্গে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান টিকে আছে, এটা ভালো খবর। ব্যবসায়িক সততা ও তৈরি মিষ্টির গুণগত মান ভালো থাকার কারণেই হয়তো এটা সম্ভব হয়েছে।