বুধবার, ৬ ডিসেম্বর, ২০২৩, ২১ অগ্রহায়ণ, ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৫

শরীয়তপুরে বেপরোয়া কিশোর গ্যাং হত্যা, অপহরণ ও মক্তিপণ আদায়ে জড়িত

 

শরীয়তপুরে বেড়েই চলছে কিশোর গ্যাংয়ের উৎপাত। কিশোর অপরাধীরা ‘গ্যাং’ বা গ্রুপ সৃষ্টি করে বিভিন্ন অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। হত্যা, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়ে জড়িত হয়ে পড়ছে তারা। মাত্র ১২ দিনের ব্যবধানে সদর উপজেলাধীন ডোমসারে এক শিশু শিক্ষার্থীকে অপহরণের পর ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবীতে হত্যা এবং একই উপজেলার শৌলপাড়ায় এক মাদ্রাসার ছাত্রীকে অপহরণের পর মুক্তিপণ দাবীর ঘটনায় আলোচনায় উঠে এসেছে কিশোর গ্যাং। এতে শঙ্কিত হয়ে পড়েছে অভিভাবক মহল। কিশোর অপরাধীরা বিভিন্ন গ্যাংয়ের মাধ্যমে তথাকথিত ‘বড় ভাইদের’ মদতে নানা অপরাধ করে বেড়াচ্ছে। প্রশাসন কঠোর হওয়ার পরও কিশোর অপরাধীদের কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। পুলিশ বলছেন, অপহরনের পর হত্যার সব আসামীদের গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের ধরে ধরে এনে চালান দিচ্ছি।
জানা গেছে, ১২ আগস্ট শৌলপাড়া ইউনিয়নের মোল্লাবাড়ির কান্দি গ্রামের রাস্তার ওপর থেকে প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় ফারজানা নামে এক মাদ্রাসা পড়–য়া ছাত্রীকে অপহরণ করে মোবাইল ফোনে তার বোন শারমিন আক্তারের কাছ থেকে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। এ ঘটনায় অপহৃতার ভাই ফয়সাল আকন পালং মডেল থানায় অভিযোগ করলে ৩ কিশোরকে আটক করে পুলিশ এবং উদ্ধার করা হয় শিক্ষার্থীকে। এছাড়া ১ আগস্ট একই উপজেলার ডোমসারে খিলগাঁও গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী মনির হোসেন খানের ছেলে শরীয়তপুর শিশুকানন কিন্ডারগার্টেন স্কুলের পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী হৃদয় খান নিবিড়কে অপহরণ করে ৫০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবী করে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ওই শিশু শিক্ষার্থীর পিতামাতা সন্ত্রাসীদের চাহিদা মোতাবেক টাকা দিতে না পারায় শিশুটিকে নির্মমভাবে হত্যা করে একটি ইটভাটার পাশে মাটিচাপা দিয়ে রাখে দুবৃর্ত্তরা। একের পর এক কিশোর গ্যাং কর্তৃক অপহরণ, হত্যার ঘটনায় শঙ্কিত অভিভাবক মহল। এদিকে জেলা শহরসহ উপজেলা সদরের অলিগলিতে কিশোর গ্যাং সদস্যরা দাপট চালিয়ে যাচ্ছে ফ্রি-স্টাইলে। বাস স্ট্যান্ড এলাকার বিভিন্ন চা-দোকানের ভেতর কিশোরদের আড্ডাবাজি চলছে। এছাড়া পাড়া মহল্লার রাস্তায় দলবদ্ধভাবে আড্ডা দেয় এক শ্রেণির কিশোর। এমনকি বিভিন্ন সময় অভিভাবকদেরও নানা ধরনের হুমকি দিয়ে আসছে তারা। তাদের ভয়ে কেউ কারো কাছে মুখ খুলতে সাহস পায় না। কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতাও নেই বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য শরীয়তপুরের জন্য এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। পথেঘাটে, চায়ের দোকান ছাড়িয়ে এখন স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় পৌঁছে গেছে তাদের গ্রæপভিত্তিক কার্যক্রম। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, কিশোর অপরাধ চক্রের বেশিরভাগ সদস্যই মাদকাসক্ত ও রাজনৈতিকের সাথে জড়িত। গাঁজা থেকে শুরু করে ফেনসিডিল ও ইয়াবা সেবনে অভ্যস্ত তারা। মাদকের টাকা জোগাতে তারা জড়িয়ে পড়ছে চুরি বা ছিনতাইয়ে। স্কুল, কলেজ ও মাদ্রাসায় শিক্ষার্থীদের আসা-যাওয়ার পথে, গেইটে এমনকি কোচিং বা প্রাইভেট সেন্টারগুলোর সামনে প্রকাশ্যেই তারা মেয়েদের ইভটিজিং করছে। বড় কোনো ঝামেলায় পড়লে ‘বড় ভাইয়েরাই’ তাদের উদ্ধার করেন। শরীয়তপুর জেলা শহরের সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনে, পালং উচ্চ বিদ্যালয়, কালেক্টর স্কুল, সরকারি গোলাম হায়দার খান মহিলা কলেজ, ভেদরগঞ্জ উপজেলা সদরে ভেদরগঞ্জ হেডকোয়ার্টার সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়, সাজনপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় গেইটে, বিঝারী উপাসী তারা প্রসন্ন উচ্চ বিদ্যালয়, পঞ্চপল্লি গুরু রাম উচ্চ বিদ্যালয়, নড়িয়া বিহারী লাল উচ্চ বিদ্যালয়, রামভদ্রপুর রেবতী মোহন উচ্চ বিদ্যালয়ের সামনের সড়কসহ বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে বসে মেয়েদের নিয়মিত উত্ত্যক্ত করছে তারা। মেয়েদের প্রতি দূর থেকে অশালীন কথা ও অঙ্গভঙ্গি করছে উঠতি বয়সের কিশোর গ্যাং সদস্যরা। সুযোগ বুঝে নারীর গায়ে হাত দেওয়া, চুল বা ওড়না ধরে টান দেওয়ার ঘটনাও ঘটাচ্ছে তারা। কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে পায়ে হেঁটে চলাচল করতে পারেন না মেয়ে শিক্ষার্থীরা। মোডিফাইড বাইক (বিকট শব্দ হয় এমন মোটরসাইকেল) নিয়ে মহড়া দেয় কিশোর গ্যাং সদস্যরা। অধিকাংশ সদস্যরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকায় তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সাহস পাচ্ছেন না স্থানীয়রা। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গ্যাং সদস্যরা ঘটাচ্ছে নানা অঘটন। খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, অপহরণসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই যা তারা করছে না। কিশোরদের বয়স ১৫ থেকে ২০ বছরের বেশি নয়। অথচ তাদের কথাবার্তা পুরোই সন্ত্রাসীদের মতো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান-বাজনা, খেলার মাঠ, ড্যান্স ও ডিজে পার্টি, বিভিন্ন ক্লাবের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখতে চায় এসব কিশোর গ্যাং। এমন চিত্র শরীয়তপুরের ৬টি উপজেলায়। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক মো: নজরুল ইসলাম, সিনিয়র শিক্ষক মোসারব হোসেন বলেন, বিদ্যালয় ছুটির সময় অথবা বিরতীর সময় বহিরাগত বখাটে ছেলেরা কেউ কেউ দু কোয়াটার পড়ে স্কুলের গেটে দাড়িয়ে থাকে অথবা স্কুলে ভিতওে ডুকে ছাত্রীদেরকে কিভিন্ন ভাবে উত্ত্যোক করে। এ বিষয়টি আজ সোমবার ভেদরগঞ্জ উপজেলা আইন শৃখলা মিটিংয়ে উপজেলা প্রেস ক্লাবের আবুল বাশার ভেদরগঞ্জ উপজেলা ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার দৃষ্টি আকশন করে বক্তব্য রাখেন।
শরীয়তপুর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও ভেদরগঞ্জ হেডকোয়ার্টার সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় নবম শেনরি ছাত্রী লিজা আক্তার, দশম শ্রেনীর তানজিয়ানুয়া, মিথীলা আক্তার, হালিমাতুজ সাদিয়াসহ অনেক শিক্ষাথীরা বলেন, স্কুলে আসা যাওয়ার পথে বখাটে ছেলেরা উত্ত্যক্ত করে। এ বিষয়ে পুলিশকে জানানোর পরও কোন প্রতিকার পাইনি।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক, সদর উপজেলার সমিতির হাট উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ হারুন-অর-রশীদ বলেন, কিশোর গ্যাংয়ের ভয়ে অনেক মেয়ে শিক্ষার্থী বিদ্যালয়ে আসাই বন্ধ করে দিয়েছে। মেয়ের নিরাপত্তার কথা ভেবে অনেক অভিভাবক ঘটনা কাউকে না জানিয়ে চুপচাপ থাকেন। এ বিষয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো তৎপরতা দেখেন না তারা। এটি উদ্বেগজনক। তবে পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে সক্রিয় রয়েছেন তারা।
ভেদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এস এম ওবায়েদুল হক বলেন, প্রতিটি স্কুলে আমাদের পুলিশ থাকে। এর মধ্যে কয়েকজনকে ধওে ২১ দিনের সাজা দেয়া দেয়া হয়েছে। এ ব্যাপাওে আমরা তৎপর আছি।
শরীয়তপুর পুলিশ সুপার মাহবুব আলম বলেন, এটা নিয়ে আমরা সত্যতার সাথে কাজ করছি। সমস্ত জায়গায় ফোর্স বাড়িয়ে দিয়েছি এবং প্রতিটি উপজেলায়।